যখন একজন লেখকের একগাদা লেখা একসাথে পড়া হয়, তখন লেখকের সামগ্রিক চিন্তা-চেতনার একটা পরিচয় পাওয়া যায়। কিছু য়ুক্তি বারবার হাজির হয়, কিছু যুক্তির বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া তৎকালীন সমাজের একটা ছবিও ভেসে উঠে পাঠকের মানসপটে। রাজশেখর বসুর প্রবন্ধসমগ্র পড়তে গিয়েও আমার সেই অনুভুতি হল। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল প্রাচীন আর সমসাময়িক বিশ্ব-পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞানের পরিধি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেছিলেন রসায়ন শাস্ত্রে, কিন্তু লেখার বিষয়ে তাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে লিখেছেন বটে, কিন্তু শিল্প-সাহিত্য-দর্শন, সংস্কৃত আর বাংলা ব্যাকরন নিয়ে ও লিখেছেন অবারিত।
তাঁর প্রবন্ধগুলোর রচনাশৈলী অসাধারন। খুব আলতোভাবে য়ুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে যান তাঁর পাঠকের জন্য। কোথাও অযাচিত হামবড়া ভাব নেই, পাঠকের সামনে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা নেই। যুক্তি দিয়ে পাঠককে পরাস্ত করা তাঁর লক্ষ্য নয়, বরং প্রবন্ধগুলো যেন পাঠককে তার চিন্তাজগৎে সাদর নিমন্ত্রন। অধিকাংশ প্রবন্ধের কাঠামো খুব সুশৃঙ্খল, শব্দচয়ন মিতব্যয়ী, লক্ষ্য তীক্ষ্ন।
প্রবন্ধগুলোতে তাঁর সমসাময়িক সমাজ-বাস্তবতার একটা চিত্র ফুটে উঠে। বিংশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাভাষা যে একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তার বেশ ভালো একটা বর্ণনা পাওয়া যায়, বিশেষ করে বাংলা বানানের পরিবর্তন, সাধু-চলিত নিয়ে সাহিত্যিকদের মতামত, বাংলা পরিভাষা ইত্যাদি। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় সমাজ, বিশেষকরে পশ্চিমবাংলা কিভাবে নব্যলব্ধ স্বাধীনতাকে বুঝতে শিখছিল তার পরিচয় ও পাওয়া যায় অনেকগুলো প্রবন্ধে। পুরো বইটা পড়লে তৎকালীন সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সম্পর্কে ভাল একটা ধারনা পাওয়া যায়।
শেষবার যখন বাতিঘরে গিয়েছিলাম, তখন এই বইটা চোখে পড়ে। রাজশেখর বসু নামটা চেনা চেনা লাগলেও মানুষটা সম্পর্কে আসলে তেমন কিছুই জানতাম না। কিছুদিন আগে তাঁর ছদ্মনাম ‘পরশুরাম’ এর কথা জেনে বইটা তাক থেকে নামিয়েছিলাম। পুরো বইটাই বেশ উপভোগ্য। বিশ শতকের প্রথমভাগের পশ্চিমবাংলা নিয়ে আগ্রহী যে কেউ বইটা উপভোগ করবে।
Published at: 07/18/2021