পাঠ-প্রতিক্রিয়া - আত্মজৈবনিক

ছোটোবেলায় একটা সময় ছিল যখন বুদ্ধদেব বসু আর গুহ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। আরেকটু বড় হবার পর বুদ্ধদেব বসুকে একটু আলাদা করে চেনা হল। হাতেগোনা কয়েকটা কবিতা ছাড়া তাঁর তেমন কিছুই তখন পড়া হয়নি। যে সময়টায় আমার কবিতা পড়ার শুরু, সেই সময়টায় আমি শক্তি-সুনীলে নিমজ্জিত। সুনীলের লেখায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে কবিতা পত্রিকার কথা, বুদ্ধদেব বসুর কথা, কিন্তু বুদ্ধদেব বসুকে আলাদা করে জানা হয়নি।

সুনীলের লেখা পড়তে গিয়েই ধারনা জন্মেছিল কবিতা পত্রিকার প্রসার আর প্রভাব সম্পর্কে। কবিতায় ছাপা হওয়াটা যে একটা তরুন লেখকের জন্য কতটা স্বীকৃতির ব্যাপার সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। এটা ও জানা হয়েছিল যে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বুদ্ধদেব হয়ে উঠেছিলেন বাংলা কবিতার একজন অভিভাবক। গতবছর নবনীতা দেব সেনের "স্বজন সকাশে" পড়তে গিয়ে আরও বিশদভাবে জানলাম কবিতা-ভবন সম্পর্কে। এবার স্বয়ং বুদ্ধদেব বসুর কলমে জানলাম তার বেড়ে ওঠার গল্প।

তাঁর জন্ম কুমিল্লায় হলেও বেড়ে ওঠার শুরু নোয়াখালিতে। দাদামশাইের হাতে বিদ্যার হাতেখড়ি। হয়তো দাদামশাই সাহিত্যানুরাগী ছিলেন বলেই বেশ ছোটো বয়সেই পদ্যের দেবী তাকে সাক্ষাত দেন। নোয়াখালিতে থাকাকালীন ক্রমাগত লিখে গেছেন তেমন কোনো সফলতা ছাড়াই, একমাত্র অর্জন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লোকের ফাই-ফরমাশ মতো পদ্য লিখে তাক লাগিয়ে দেয়া। আমার ধারনা এই ক্রমাগত লিখে যাওয়ার অভ্যাসটাই গড়ে দিয়েছিল ভবিষ্যতের গাথুনীটা।

আমার কাছে বইটার সবচেয়ে আকর্ষনীয় অংশ তার যৌবনের গল্প। এই গল্পের শুরুটা ঢাকায়। এই ঢাকার সাথে আমার তেমন পরিচয় ছিল না। সেই প্রায় একশ বছর আগের ঢাকা শহরটা বেশ লাগলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবে শুরু হয়েছে, শিক্ষক-ছাত্র সবার মধ্যেই একটা আপন-আপন ভাব। সবচেয়ে মজার লাগলো পরীক্ষার সময় বুদ্ধদেব বসুর চায়ের নেশা মেটাতে শিক্ষকদের চা আনিয়ে দেয়া, পরীক্ষার মাঝে বিরতি দিয়ে সিগারেট খেতে যাওয়া। ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের সাহিত্যানুরাগ ও বেশ চোখে পড়লো। তবে উল্লেখ না থাকলেও বর্ণনা থেকে বোঝা যায় সমাজে একটা সাম্প্রদায়িক বিভক্তি ছিল।

তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটা হল, তিনি শুধু নিজেই লেখেননি, তার ঝোঁক ছিল অন্যদের লেখনীর সাথেও সবার পরিচয় করিয়ে দেবার দিকে। আর এইজন্যে পত্রিকা চালাতে গিয়েই সুহৃদ হয়েছেন সমকালীন অনেকের সাথে, রবীন্দ্রনাথ ও বাদ যান নি। পত্রিকাগুলোর তত্বতালাশ করতে জানা হলো দলভারী করে ঝগড়া করার অভ্যাস তখনকার বাঙ্গালী কবিদের মধ্যেও বিরল ছিল না।

সময়ের সাথে ঢাকার আকর্ষন ফুরিয়ে যায়, তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। তাঁর কলকাতাবাসের সময়টাতেই তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন বাংলা কবিতার একটি প্রতিষ্ঠান। সবকিছু যে চোখের পলকে হয়েছিল তা নয়, অনেক সংগ্রাম ছিল, অর্থনৈতিক এবং সাহিত্যিক, দুই ধরনেরই। এই সময়টার যেটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেটা হল সমসাময়িক অগুনিত নক্ষত্রের জীবনে তাঁর অগাধ বিচরন। কবিতাভবনের আড্ডাগুলো নিঃসন্দেহে আমার ইর্ষার বস্তু হয়ে থাকবে। ধোঁয়া-ওঠা চায়ের কাপসহ এইরকম নির্ভেজাল আড্ডা আমি ফেলে এসেছি অনেক দুরে।

বুদ্ধদেব বসু বইটা শেষ করে যান নি। তাই শেষের অনেক গল্পই অজানা থেকে গেল। তার কন্যা দয়মন্তী শেষের রাশটুকু টেনে দিয়েছেন। কিছু অপ্রিয় কথা উঠে এসেছে সেখানে, লেখক স্বয়ং হয়তো সেগুলো এড়িয়ে যেতেন।

অনেকদিন পর নিটোল গদ্যের ঝংকারে বাংলা পড়লাম। লেখককে জানা হলো, এবার আরো কিছু লেখনী খুঁজে বের করা দরকার।

Published at: 05/09/2020